স্থাপত্যকলায় আধুনিকতা বা ‘Modernism’এর সূচনা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কিছু স্থপতির আধুনিক স্থাপত্য কৌশলে তৈরি অনবদ্য সব স্থাপত্যগুলোই আধুনিকতা এনেছিল স্থাপত্যকলায় ; আর এই আধুনিকতার সূচনায় অন্যতম সাফল্য এনেছিল ফ্রান্সের পয়সি শহরের এক সাধারণ পার্মানেন্ট রেসিডেন্স, “ভিলা স্যাভয়”।
এর স্থপতি “লে করবুসিয়ের”-এর আধুনিক স্থাপত্য কৌশল একে করে তুলেছে অনন্য ও অসাধারণ। আজ আপনাদের শোনাবো এই – “ভিলা স্যাভয়”-এর সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প।
ভিলা স্যাভয় প্রসঙ্গে বলার আগে ,“লে করবুসিয়ের”-এর সম্মন্ধে কিছু না জানলে হয়ত , পুরো গল্পটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাই প্রথমেই জানিয়ে রাখি, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে স্থাপত্যকলার নবজাগরণে এই স্থপতির অবদান এতটাই গুরুত্তপূর্ণ ছিল যে, তাকে আধুনিক স্থাপত্যকলার গডফাদার বললেও অত্যুক্তি হবে না। আজকে যেমন মার্ক জুকেরবারগ, স্টিভ জোভস বা বিল গেট্স-কে যেমন তথ্য প্রজুক্তির পথিকৃৎ হিসেবে অভিহিত করা হয় , ঠিক তেমনই এই সুইস-ফ্রেঞ্চ স্থপতি ছিলেন স্থাপত্যকলার দুনিয়ায় আধুনিকতার প্রধান পথিকৃৎ।
১৯২০সাল থেকে ১৯৩০সাল, সময়টা ছিল করবুসিয়ের সাহেবের কর্মজীবনের স্বর্ণযুগ। ১৯২০ সাল থেকে তার আধুনিক কৌশলে তৈরি স্থাপত্যগুলির দৌলতে তিনি এই সময় প্রায় সারা বিশ্বে নামকরা স্থপতি হিসেবে পরিচিত।এমনি সময় ১৯২৮ সালে ফ্রান্সের পারিস শহরের অধিবাসী পিয়ের সাভয় এবং ইউজিনি সাভয়ের প্রস্তাবে ,তাদের পার্মানেন্ট রেসিডেন্স হিসেবে করবুসিয়ের সাহেব ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে ফ্রান্সের পয়সি শহরে নির্মাণ করেন “ভিলা সাভয়”।
পয়সি শহরের ‘আভেনিউ-ব্লাঞ্চ-দে-কাসিল’ নামক রাস্তার পাশে চারিদিকে অরণ্যে ঘেরা একটি সবুজ মাঠের ঠিক মাঝখানে তৈরি হয় ‘ভিলা সাভয়’। প্রধান রাস্তা ছেড়ে ছোট রাস্তা ধরে বাড়ির সীমানায় ঢুকে -সবুজ গাছপালার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেলে দেখতে পাওয়া যায় বাড়িটা।
‘ভিলা সাভয়’-এর সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার প্রধান কারন ছিল তার অদ্ভুত গঠন-আকৃতি । প্রথমবারের জন্য বাড়িটা দেখলেই আপনার মনে হবে কতগুলো লাঠির ওপর কেউ যেন একটা চৌকো বাক্স রেখে দিয়েছে। ঠিক যেমনটা ছিল ছেলেবেলার সার্কাসে বা মেলায় রণপা পরে হেটে বেড়ানো মানুষগুলো ; এখানেও যেন কতগুলি রণপার উপর দাড়িয়ে রয়েছে বাড়িটা।
গৃহ নির্মাণের জটিলতা কে ভুল প্রমান করে, মাত্র চার পাশে চারটে দেওয়াল দিয়ে তৈরি ঘনক-আকৃতির বাড়িটা প্রতি মুহূর্তে মনের মধ্যে সৃষ্টি করে এক অজানা উৎসাহের । বাইরে থেকে দেখে বাড়িটাকে খুব ছোট বলে মনে হলেও , একবার ভিতরে ঢুকলে দেখতে পাবেন একটা পরিবার থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত জায়গাগুলোই এখানে উপস্থিত ।
অদ্ভুত ব্যাপারটা হল, সাধারণত যেকোনো বাড়ির সীমানায় ঢুকলে প্রথমেই বাড়ির মেইন এন্ট্রান্স চোখে পরে, কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা পুরো উলটো। বাড়ির সীমানায় ঢুকে প্রথমেই বাড়ির যে দিকটা চোখে পরে তা আসলে বাড়ির পিছন দিক। যার দুপাশে সমান্তরালে উপস্থিত একের পর এক স্তম্ভ, আর তার উপরে বাড়ির ঘনকাকার ফার্স্ট ফ্লোর ।ঠিক নিচে দুপাশে স্তম্ভ গুলির পাশে গাড়ি যাওয়ার রাস্তা, আর মাঝখানে চারিদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা গ্রাউন্ড ফ্লোর।
এই রাস্তা ধরে এগিয়ে গিয়ে উল্টো দিকে ফার্স্ট ফ্লোরের ছাদের ঠিক নিচে মাঝামাঝি জায়গায় বাড়িতে ঢোকার মেইন এন্ট্রান্স । বাড়িটা বাইরে থেকে দেখে শুধুই চারপাশে চারটে দেওয়াল দিয়ে তৈরি মনে হলেও, প্রধান দরজার দুপাশের দেওয়াল কিন্তু কার্ভড(বক্র-আক্রিতির)। যা দুপাশ থেকে বিস্তৃত হয়ে ক্রমশ পিছনের সমান্তরাল দেওয়ালে মিশে গেছে।আর চারপাশে বিস্তৃত স্তম্ভগুলো রণপার মত উপরের ফার্স্ট ফ্লোরটাকে ধরে দাড়িয়ে আছে। প্রধান দরজা ছেড়ে ডান দিকের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলে দেওয়ালের বিস্তারের মধ্যেই চোখে পরবে গাড়ি রাখার গ্যারাজ।
এছাড়া বাড়ির মেইন এন্ট্রান্স দিয়ে ঢুকে প্রথমেই গ্রাউনড ফ্লোরে আছে এন্ট্রান্স হল ,তার ঠিক বাঁদিকে দুটো সারভেন্টস রুম সহ পিছনে একটা ইউটিলিটি রুম ও ড্রাইভারস রুম।
গ্রাউনড ফ্লোর ছেড়ে ফার্স্ট ফ্লোরে আসলে প্রথম যে জায়গাটা সব থেকে আকর্ষণীয় লাগবে তা হল, লিভিংরুম লাগোয়া ছাদবিহীন কোর্টইয়ার্ড অংশটা । এই কোর্টইয়ার্ডের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট বাগান। ঠিক যেন এক খোলা আকাশের নিচে এক ঝুলন্ত উদ্যান , যা প্রত্যেক মুহূর্তে বাড়ির আবদ্ধ পরিবেশ আর বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশকে এক করে তুলছে। একই ভাবে লাগোয়া লিভিংরুমেও কোর্টইয়ার্ডের মনোরম পরিবেশের সরলতা বজায় রাখার জন্য দুটো জায়গার মধ্যে ইট বা কংক্রিটের দেওয়ালের পরিবর্তে আছে বিস্তৃত কাচের দেওয়াল । যাতে আপনি ঘরের মধ্যে থেকেও বাইরের প্রকৃতিকে প্রতি মুহূর্তকে উপভোগ করতে পারবেন।
তাছাড়া এই ফ্লোরে উত্তরে আছে পিয়ের সাভয় ও ইউজিনি সাভয়ের বেডরুম সহ তাদের ছেলের বেডরুম।তার ঠিক পাশে পশ্চিমে একটা গেস্টরুম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে রান্নাঘর আর বেডরুমগুলির সাথে লাগোয়া টয়লেট।
তবে এই ফ্লোরের অন্যতম আকর্ষণ কিন্তু বাইরের দেওয়াল আর জানালাগুলো। শুনলে অবাক হবেন, এই ফ্লোরে যত গুলো বাইরের দেওয়াল বা জানালা আছে তার কোনটাই কিন্তু প্রতিটা ঘরের জন্য আলাদা আলাদা করে তৈরি না। তার পরিবর্তে ফ্লোরের উপর চারপাশে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আছে টানা বিস্তৃত চারটে দেওয়াল আর একইভাবে এই চারটে দেওয়ালের ঠিক মাঝখানে উপস্থিত এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ফিল্মস্ট্রিপের মত বিস্তৃত কাঁচের জানালা। যার প্রধান কারন, বাড়ির চারিদিকে ঢাকা সবুজের দৃশ্যকে জানালার মাধ্যমে চলমান রেখে তাকে অন্দরমহলের এক অংশ করে তোলা । আর তার পাশাপাশি প্রতিটা ঘরের মধ্যে বাইরের সবুজ প্রকৃতির সৌন্দর্য তথা পরিবেশের অনুপ্রবেশ ঘটানো । এমনকি, যার জন্য ‘করবুসিয়ের সাহেব’ বাড়ির উচ্চতা ও জানালার উচ্চতা নির্ধারণ করেছিলেন বাইরের গাছের উচ্চতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে।
ভিলা সাভয়ে এই দুটি মাত্র ফ্লোর থাকলেও,এর গল্প কিন্তু এখানেই শেষ না। কারন আসল জিনিসটাই তো আছে বাড়ির ছাদে।
বিভিন্ন আকারের কার্ভড (বক্র) দেওয়ালের সমন্বয়ে তৈরি ছাদবিহীন এমন এক জায়গা, যার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে ছোট ছোট বাগান। আর তার মধ্যে চারিদিকের সবুজ প্রকৃতির সাথে নীল আকাশের মিলনে এমন এক অদ্ভুত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে , যা আপনার মনকে এক অন্য জগতে নিয়ে যাবে। কোলাহল মুক্ত এই শান্ত পরিবেশ আপনার একাকিত্বে এক অজানা বন্ধুর মত আপনার মধ্যে আনন্দসুখের সৃষ্টি করবে।
এছাড়া আরও একটি মজার ব্যাপার হল, বাড়িতে প্রতিক্ষেত্রে নিচের ফ্লোর থেকে উপরের ফ্লোরে যাওয়ার জন্য কিন্তু, প্রধান মাধ্যম হিসেবে সিঁড়ির পরিবর্তে আছে র্যাম্প।বাড়ির যাতায়াতের সুবিধার পাশাপাশি চারদিকে স্বল্প পরিসরে সব ঘরগুলির অবস্থানের জন্য ,বাড়ির ঠিক মাঝখানে করবুসিয়ের সাহেব রাম্পগুলোকে বসিয়েছিলেন। তবে প্রধান যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে রাম্প থাকলেও, বাড়িতে সিঁড়ির উপস্থিতি যে একেবারেই নেই তা নয়। প্রতিক্ষেত্রে র্যাম্পের ঠিক বাঁদিকে আছে একটা ঘূর্ণায়মান গোলাকার সিঁড়ি, যা র্যাম্পের বিকল্প হিসেবে সংযোগস্থাপন করেছে প্রতিটা ফ্লোরের মধ্যে।
আশাকরি এতক্ষণে আপনি নিজেও অনুভব করছেন বাড়িটার অসাধারণত্ব ! তবে গল্প শুনে বাড়ির ডিজাইনটা যতটা সরল মনে হচ্ছে , আসলে ঠিক ততটাই জটিল ছিল বাড়িটার নির্মাণ । বাড়ি তৈরির খরচা খুব সীমিত থাকার ফলে করবুসিয়ের সাহেবকে বারবার বাড়ির ডিজাইন চেঞ্জ করতে হয়েছিল । শেষমেশ তো বাড়ির সমস্ত জায়গাগুলোকেই এক সীমিত ঘনক-আকৃতির অঞ্চলের মধ্যে আবদ্ধ করতে হয়েছিল। এছাড়াও আধুনিকতা আনার জন্য করবুসিয়ের সাহেব তার “ফাইভ পয়েনটস অফ আর্কিটেকচার”-তত্ত্ব অনুসরন করে তৈরি করেন বাড়িটা। যার ফলে বিংশ শতাব্দীর এই স্থাপত্য হয়ে ওঠে চিরকালের জন্য স্থাপত্যকলার এক অনন্য অবদান ও প্রতি স্থপতির কাছে এক আইকনিক রেসিডেন্স।
পুরোটা পড়ার পর হয়ত আপনার মনের মধ্যেও ইচ্ছা জাগছে যে আপনারও যদি এরকম একটা বাড়ি হত! আপনার এই আশাপূরণ হবে কিনা তা একমাত্র বর্তমান সময়ের স্থপতিরাই বলতে পারবেন। আমি আপনাদের এটুকু জানাতে পারি, ভিলা স্যাভয় কিন্তু এখন আর কোন পার্মানেন্ট রেসিডেন্স নয়,বরং ফ্রেঞ্চ গভর্নমেন্টের অধীনে এক আর্কিটেকচারাল মিউজিয়াম। তাই কোনোদিন ফ্রান্স গেলে , কিছুটা সময় ভিলা স্যাভয়-তে কাটাতেই পারেন। এই মুহূর্তে আপনার কৌতূহলকে নিবৃত্তির জন্য কিছু ইউটিউব লিঙ্ক তো রইলই-
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
লিখেছে – Abhirup Dey , ছবি – গুগল ইমেজেস ।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………
***আমাদের ফলো করুন নীচের লিঙ্কে ক্লিক করে –
INSTAGRAM – https://www.instagram.com/sthapatya_kala/
TWITTER – https://twitter.com/Sthapatya_Kala
E-MAIL NEWSLETTER – http://eepurl.com/cQpVIz
FACEBOOK GROUP – https://www.facebook.com/groups/sthapatya.kala/
Hits: 243