স্থাপত্যের শেষ দুটো আর্টিকেলে আপনাদের জানিয়েছি পৃথিবীর দুই প্রান্তের , অদ্ভুত দুই বিদেশী স্থাপত্য সম্বন্ধে । আজকে লিখতে বসে মনের মধ্যে থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এলো -“অনেক তো বিদেশের কথা হল , এবার বরং একটু দেশের দিকে তাকানো যাক।” তাই আজ আর ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয় , আজকের লেখা – গুজরাটের এক অসাধারণ ভারতীয় স্থাপত্যকে নিয়ে ।
এদেশের মূলধারার সংবাদ মাধ্যম কিম্বা সোশ্যাল-মিডিয়ায় যে আর্কিটেকচার নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয়না , এ তথ্য আশাকরি আপনাদের কাছে নতুন কিছু নয় । তাই আজকের গল্প লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা এমন এক স্থাপত্যকে নিয়ে , যার গঠন-আকৃতি থেকে শুরু করে অন্দরমহলের পরিবেশ সব কিছুতেই সমানে সমানে টক্কর দেয় পৃথিবীর নামীদামী স্থাপত্যগুলোকে।
কি ভাবছেন এদেশে এরকম স্থাপত্য? এ ও সম্ভব নাকি?
হ্যাঁ সম্ভব।
চার্লস কোরিয়ার নাম শুনেছেন? না তো?
স্বাভাবিক, কারন ইনি কোন বিখ্যাত লেখক , অভিনেতা বা ক্রিকেটার নয় যে ভারতের মিডিয়ায় এনার নাম শোনা যাবে । চার্লস কোরিয়া ছিলেন স্বাধীনতা পরবর্তী যুগের এক ভারতীয় স্থপতি। না , কেবলই এক ভারতীয় স্থপতি নয়। লে করবুসিয়ের বা এফ এল রাইট যদি ইউরোপীয় বা মার্কিন প্রদেশে আধুনিক স্থাপাত্যের পথপ্রদর্শক হন, তবে নির্দ্বিধায় বলা যায় আধুনিক ভারতীয় স্থাপত্যকলার প্রবর্তক ছিলেন কোরিয়া । তার ৮৪ বছরের জীবনে , ভারতীয় ঐতিহ্য বজাই রেখে তৈরি অনবদ্য সব স্থাপত্যগুলির জন্য তাকে ‘ভারতীয় স্থাপত্যের অগ্রগামী’-ও বলা হয়। আর এই সব স্থাপত্যের মধ্যে অন্যতম হল রামকৃষ্ণ হাউস। রামকৃষ্ণ মঠ বা রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের বাড়ির কথা বলছি না , গুজরাতের আহমেদাবাদের রামকৃষ্ণ হাউসের কথা বলছি ।
১৯৬২ সাল থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে গুজরাতের আহমেদাবাদে, এক কলকারখানার মালিকের জন্য চতুর্ভুজ আকৃতির এক জমির দক্ষিনে এক বিশাল উঠোন নিয়ে উত্তরদিক ঘেঁষে তৈরি হয় এই অদ্ভুত আকৃতির রামকৃষ্ণ হাউস।
অদ্ভুত! হ্যাঁ সত্যিই অদ্ভুত , বাড়িটাকে প্রথমবার দেখলে আপনি পার্মানেন্ট রেসিডেন্স বলে মেনেই নিতে পারবেন না। দেখলে মনে হবে ঠিক যেন অন্য গ্রহ থেকে আসা কোনো এলিয়ানদের স্পেসশিপ। গড়পড়তা ভারতীয় রেসিডেন্স বলতে বোঝে , চারিদিকে সারি সারি জানালা-দরজাওয়ালা কতগুলো বাক্স । কিন্তু এক্ষেত্রে জানালা কই?
আছে,তবে তা খুবই কম। শুধুই যেন একটা ইটের স্তুপ, যার ছাদের ঠিক মাঝখানে চিমনি সদৃশ এক ক্যানন আর তার দুপাশ থেকে তির্যক ভাবে পূর্ব-পশ্চিমে নেমে গেছে ঢালু ছাদ । বাড়ি কম , যেন যন্ত্রই বেশি। হ্যাঁ যন্ত্রই বটে ,এ ভাবনা শুধু আমার আপনার নয় , এধরনের বাড়ি স্থাপত্যকলায় “মেশিন ফর লিভিং” নামেই পরিচিত।
তবে এরকম গঠন-আকৃতি দেখে ভেবে বসবেন না যেন, শুধুই আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য বাড়িটাকে এরকম আকৃতি দেওয়া হয়েছিল। বরং কারণটা ছিল,বাড়ি তৈরির খরচ কমানোর সাথে সাথে বাড়িটাকে পরিবেশ-বান্ধব করে তোলা। কেমন একটা লাগছে না শুনতে ? এদেশে কম খরচে পরিবেশ-বান্ধব বাড়ি!
”নৈব নৈব চ!!” অসম্ভব।
উপযুক্ত স্থাপত্যবিদের শরনাপন্ন হলে সবকিছুই সম্ভব । আসুন জেনেই নিই , কিভাবে এ অসাধ্য সাধন করেছিলেন চার্লস কোরিয়া?
প্রথমেই জানিয়ে রাখি, বাড়িটা কিন্তু ভারতের অন্যতম উষ্ণতম অঞ্চলের অন্তর্গত , আর এই গরম আবহাওয়াই এখানকার প্রধান সমস্যা । চার্লস কোরিয়া খুব সরল এক কৌশল অনুসরন করে বাড়িটাকে মুক্ত করেন এই উষ্ণতম পরিবেশ থেকে। তিনি মুলত বাড়ির দুপাশের ছাদ ঢালু করে তার মিলনস্থলে এক চিমনি সদৃশ ক্যানন এর উপস্থাপন করেন, যাতে বাড়ির ভেতরের হালকা গরম হাওয়া নিচের থেকে ক্রমশ উপরে উঠে এক জায়গায় আবদ্ধ না থেকে বাড়ির ঢালু ছাদ বেয়ে উপরের ক্যানন দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। আর এর পরিবর্তে বাড়ির পরিবেশকে তুলনামুলক ঠাণ্ডা করে তুলতে বাড়ির নিচে চারপাশে উপস্থাপন করেন চারটে বড় বড় দরজা । যাতে নীচে চারপাশ থেকে ঠাণ্ডা বাতাস বাড়িতে ঢুকে , ভিতরের পরিবেশকে মনোরম করে তুলতে পারে। এছাড়াও বাড়ির মধ্যে বায়ু চলাচল আরও বৃদ্ধি ও সরল করার জন্য দরজা জানালার সংখ্যাও স্বাভাবিকের তুলনায় কমিয়ে দেন। এর ফলে বাড়ি তৈরির খরচ অনেক কমে যাওয়ার পাশাপাশি বাড়িটা হয়ে ওঠে পরিবেশ বান্ধব। (চার্লস কোরিয়ার এই ধরনের নির্মাণ কৌশলে তৈরি বাড়ি ভারতীয় স্থাপ্ত্যকলায় “টিউব হাউস” নামে পরিচিত।)
খরচা কম হওয়ার কথা শুনে আপনার নিশ্চয় মনে হচ্ছে যে, হয়ত বাড়িটা হয়ত স্বাভাবিকের তুলনায় ছোট, কিম্বা হয়ত একটা পরিবার থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সব জায়গাগুলোই হয়ত নেই বাড়িতে। তাহলে বলি,একবার অন্দরমহলে ঢুকলেই বুঝতে পারবেন কি আছে আর কি নেই?
উত্তর দিকের এন্ট্রান্স দিয়ে বাড়ির সীমানায় ঢুকলে সবার প্রথমেই চোখে পরে বাড়ির সামনের এন্ট্রান্স লবি যার বাঁ দিকে একটা পারগোলার নীচে বাড়ির মেইন এন্ট্রান্স বা মূল প্রবেশদ্বার ।আর একটু এগিয়েই ডান দিকে গাড়ি রাখার গ্যারেজ ,আর ঠিক তার সামনে কতগুলো সারভেন্টস কোয়ার্টার।
লম্বা অদ্ভুৎ আকৃতির দেখতে হলেও, শুনলে অবাক হবেন, রামকৃষ্ণ হাউস কিন্তু দুটো ফ্লোর নিয়ে তৈরি। আর যার মধ্যে মেইন এন্ট্রান্স দিয়ে ভিতরে ঢুকেই ফার্স্ট ফ্লোরের একদিকে আছে ডাইনিং রুম আর একপাশে লিভিংরুম। আর ঠিক মেইন এন্ট্রান্সের বিপরীতে লিভিংরুম আর ডাইনিং রুমের দক্ষিনে আছে এক বিস্তৃত দরজা। এই দরজা দিয়ে বেড়িয়ে বাইরে আসলে দেখা যায় তিন্ দিকে সবুজ গাছপালা দিয়ে ঢাকা অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত উঠোনটা। এই উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাড়িটার দিকে তাকালে, রামকৃষ্ণ হাউসের প্রধান সৌন্দর্যটা চাক্ষুষ করা যায়। বাইরের সবুজ প্রকৃতিকে বাড়ির এক অংশ করে তোলার পাশাপাশি, ভারতীয় উষ্ণ পরিবেশে প্রতিদিনের সকালবেলা এবং বিকেলবেলার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশকে উপভোগ করতেই দক্ষিনে এই উঠোনের উপস্থাপনা।
এছাড়াও লিভিংরুমের বাঁদিকে আছে একটা গেস্টরুম আর ডাইনিং রুমের ডানদিকে একটা রান্নাঘর ও টয়লেট। তবে এই ফ্লোরের আকর্ষণীয় জায়গা কিন্তু এন্ট্রান্স লবির মাঝের আর গেস্ট রুমের পাশের দুটো ছোট ছোট কোর্ট। বাহারি গাছপালা সহ সম্পূর্ণ কুচি পাথর দিয়ে আবরিত এই কোর্ট দুটো দেখলেই মনে হয়, বাইরের উঠোনটা যেন প্রসারিত হয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তাছাড়াও বাড়ির পূর্ব-পশ্চিমে আছে বাড়ি-লাগোয়া দুটো ছোট্ট সবুজ বাগান আর তার একপাশের বাগানের মাঝে উপরি পাওনা হিসেবে আছে একটা ছোট ওয়াটারপুল। ঠিক যেমনটা সবাই চায় নিজের স্বপ্নের বাড়িতে।
তবে এখানেই শেষ নয়, ফার্স্টফ্লোর ছেড়ে সিঁড়ি দিয়ে সেকেন্ড ফ্লোরে উঠলে প্রথমেই চোখে পরে একপাশ খোলা একটা সিটিংরুম, যার পশ্চিমে দুটো ছোট বেডরুম সহ পূর্বদিকে একটা মাস্টার বেডরুম। আর এই মাস্টার বেডরুমের সাথে লাগোয়া একটা স্টাডিরুম। সারা বাড়ির ছাদ ঢালু হলেও, এই ফ্লোরে সিটিংরুম থেকে বেরোলে পূর্বদিকে কিন্তু সমতল ছাদের দেখা মিলবে।যার মাঝামাঝি নিচের এন্ট্রান্স কোর্ট আর গেস্টরুম কোর্টের ওপরে আছে মুখ বের করা দুটো লম্বা স্কাইলাইট। যেখান থেকে আলো প্রবেশ করে এই জায়গা দুটোকে আরো মায়াবি করে তুলেছে।
এবার ধারনা করতে পেরছেন নিশ্চই যে বাড়ির খরচ কমাতে গিয়ে কোন চাহিদার অসম্পূর্ণতা থেকে যায়নি , বরং তার পরিবর্তে স্বাভাবিক বাড়িগুলির থেকে অনেক কিছু বেশিই পাওয়া গেছে রামকৃষ্ণ হাউসে।
রামকৃষ্ণ হাউস ভারতীয় স্থাপত্যকলায় আধুনিকতার এক উদাহরণ হলেও, মজার ব্যাপার হল বাড়ি তৈরিতে কিন্তু ব্যবহার করা হয়েছে পুরোনো স্থাপত্য কৌশল । বিংশ শতাব্দীর এই সময়টাতে মানুষ বাড়ি তৈরির জন্য কংক্রিটের পিলারের পাশাপাশি ঢালাই ছাদের ব্যবহার শুরু করেছিলেন। এখানে কিন্তু কোরিয়া সাহেব এই বাড়ির স্ট্রাকচার থেকে শুরু করে ছাদ – সবকিছুতেই ব্যবহার করেছিলেন কেবলমাত্র ইট, যা স্থাপত্যকলায় লোড-বিয়ারিং স্ট্রাকচার নামেই পরিচিত। লোড-বিয়ারিং স্ট্রাকচারের উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পুরনো দিনের মোটা মোটা দেওয়ালের ইটের বাড়ি যেখানে মূলত দেওয়াল গুলোই গোটা বাড়ির সমস্ত রকম ভার বা লোড নিয়ে মাটিতে চালান করে দেয় ।
নির্মাণ কৌশলে আধুনিকতা না এলেও, বাড়িটার গঠন আকৃতি থেকে শুরু করে পরিবেশ-বান্ধব করে তোলার পাশাপাশি খরচ কমানোর জন্য যে আধুনিক পদ্ধতি উপস্থাপন করেছিলেন চার্লস কোরিয়া, তার জন্যই এই বাড়ি হয়ে উঠেছে আধুনিক ভারতীয় স্থাপত্যকলার এক অনবদ্য উদাহরণ। তাই আজও এদেশের গড়পড়তা সাধারন বাড়িগুলোর থেকে আলাদা হয়ে – ঠিক যেন এক স্বপ্নের বাড়ির মতই রামকৃষ্ণ হাউস হয়ে উঠেছে এক অনন্য স্থাপত্যকীর্তি ।
Hits: 3493