দিল্লি – কিছু অজানা তথ্য
আমি যখন প্রথম দিল্লি তে আসি তখন দিল্লির ব্যাপারে খুব কমই জানতাম। আর পাঁচজন সাধারনের মতনই দিল্লি বলতে আমার মনে ভেসে উঠত দুটো শহর – পুরোনো দিল্লী আর নতুন দিল্লী। কিন্ত কর্মসূত্রে যত সময় যায় , জানতে পারি এই সুপ্রাচীন শহরের সেই গৌরবময় ইতিহাস। আজ এই লেখায় সেই অজনা ইতিহাসেরই খানিকটা তুলে ধরব ।
দিল্লী হল এমন এক শহর যেটা যুগে যুগে ফিনিক্স পাখির মতো বার বার নিজের ছাই থেকেই জেগে উঠেছে নতুন করে বাঁচার তাগিদে । আজ যে দিল্লি শহরকে আমরা দেখি সেটা হল এর দশম শহর । সময়ের চাকায় এর আগে প্রায় নয়বার পিষ্ট হয়েছে শহর দিল্লি , তবু তার অফুরান প্রানশক্তির উপর ভর করে আবার জন্ম নিয়েছে নতুন অবতারে । যিশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় দুহাজার বছর আগে থেকে বার বার বিভিন্ন রাজবংশ দিল্লীকে তাদের শক্তিকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেছে । এর ভৌগলিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়েছে গোটা ভারতবর্ষকে রাজত্ত্ব করার জন্য। মির্জা গালিব এর ভাষায়
“I asked my soul: What is Delhi? She replied: The world is the body and Delhi its life!” (আমি নিজের আত্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম দিল্লী কি? সে বলল – বিশ্ব হল শরীর আর দিল্লী তার প্রাণ ।)

বলা হয় যে যিশু খ্রিস্টের জন্মের দুহাজার বছর পূর্বেও এখানে জনবসতি ছিল (যেখানে বর্তমান দিল্লী শহর অবস্থিত) । প্রথম যে শহর এর কথা জানা যায় এই অঞ্চলে সেটা ছিল ইন্দ্রপ্রস্থ , যার উল্লেখ আছে মহাভারতে । পাণ্ডবদের প্রতিষ্ঠিত সেই রাজধানী শহর সম্ভবত এখানেই ছিল। দিল্লির পুরোনো কেল্লার নিচে সেই শহরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। এরপর জানা যায় ১০৬০ শতাব্দীতে রাজা ‘অনঙ্গপাল তোমার’ তার রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন এখানে। তখন এই শহরের নাম ছিল লালকোট। আজও এই শহরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় এই শহরের মেহরৌলি অঞ্চলে। এরপর ১১৮০ শতাব্দী তে পৃথ্বীরাজ চৌহান পুরোনো লালকোটকে দখল করলে এর নাম হয় ‘কীলা রাই পিথোরা’ ।
১১৯২ তে মোহম্মদ ঘোরী পৃথ্বীরাজ চৌহানকে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পরাজির করে কীলা রাই পিথোরায় লুটপাট করেন। এরপর দিল্লিতে শুরু হয় সুলতানী শাসনের। পরপর পাঁচটা রাজবংশ দিল্লী তে রাজত্ব করে – দাশ বংশ (১২০৬-১২৯০), খিলজী বংশ (১২৯০-১৩২০) , তুঘলক বংশ (১৩২০-১৪১৪) , সৈয়দ বংশ (১৪১৪-১৪৫১) এবং লোদী বংশ (১৪৫১-১৫২৬)) । এদের সবার রাজধানী ছিল এই দিল্লী শহরেরই বিভিন্ন প্রান্তে।
কুতুবুদ্দিন অইবক দাস বংশের প্রতিষ্ঠাতা ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে রাজত্ব করতেন পুরোনো কীলা রাই পিথোরা থেকেই। বর্তমান মেহরৌলি অঞ্চলের আশেপাশে সেই সময়কার অনেক পুরোনো অবশেষ দেখা যায় যার মধ্যে অন্যতম কুতুব মিনার। ইদানিং এই কুতুব মিনারের নির্মাণকাল এবং নির্মাতা কে , এই নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে । কুতুব কমপ্লেক্সে ঘুরে বেড়ালে বহু প্রাচীন হিন্দু দেবদেবীর ভাঙ্গা টুকরো চোখে পরে ( সম্ভবত প্রাচীন হিন্দু এবং জৈন মন্দিরের ভাঙ্গা অংশ) । তবে মিনারের মূল স্থাপত্যরীতি দেখে আনুমান করা যায় , মিনার এবং তার আশেপাশের স্থাপত্যের নির্মাণের সময় মন্দিরের ভাঙ্গা টুকরো ব্যবহার করা হলেও ৭৩ মিটার উচ্চতার মূল মিনারটি কুতুবুদ্দিন অইবকের সময়েই নির্মিত ।
১২৯৭ খ্রিস্টাব্দে খিলজী বংশের আলাউদ্দিন খিলজী প্রতিষ্ঠা করেন চতুর্থ শহর সিরি। যার অবশেষ দেখা যায় বর্তমান সিসিফোর্ট অডিটোরিয়াম এর কাছে। এরপর পঞ্চম শহরের প্রতিষ্ঠা করেন তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতা – গিয়াসুদ্দীন তুঘলক। ফলে এই শহরের নাম হয় তুঘলকাবাদ। কিন্তু সেই শহর কিছুদিনেই খালি হয়ে হয় জলের অভাবে। আজও এই শহরের অবশেষ , প্রাচীর আর গম্বুজ দাঁড়িয়ে আছে দিল্লীর দক্ষিণ প্রান্তে। গিয়াসুদ্দীন তুঘলক নিজের রাজধানী ফিরিয়ে আনেন আবার মেহরৌলি অঞ্চলেই ।

এরপরের শহরের পত্তন করেন মোহাম্মদ বিন তুঘলক । ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত এই শহরের নামকরণ করেন জাঁহাপনাঃ (meaning in Persian: “Refuge of the World”) । এই শহরটা ছিল পুরোনো কীলা রাই পিথোরার পাশেই। বর্তমানে আই. আই. টি. দিল্লীর সংলগ্ন এলাকায় এর অবশেষ দেখা যায়। এর অন্যতম অবশেষগুলো হল বেগমপুর মসজিদ , বিজয় মন্ডল ,কালুসারাই মসজিদ, লাল গম্বুজ ইত্যাদি। মোহাম্মদ বিন তুঘলক এর মৃত্যুর পর রাজা হন তারই ভাইপো ফিরোজ শাহ তুঘলক এবং ১৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে নিজের রাজধানীকে আরো উত্তরে সরিয়ে নিয়ে যান । সেই রাজধানীর নাম ছিল ফিরোজাবাদ।

এরপর দিল্লিতে সৈয়দ ও লোদী বংশ রাজত্ব করলেও কোনো নতুন শহর প্রতিষ্ঠা করেননি তারা। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে বাবর প্রথম পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করলে মোঘল শাসনের প্রতিষ্ঠা হয়। স্বভাবতই এই শহর দখলে আসে মোঘলদের । পরবর্তীকালে আবার বাবরের পুত্র হুমায়ুন প্রতিষ্ঠা করেন দিনপানাহ শহর যেটা বর্তমানে ‘পুরানা কীলা’ নাম পরিচিত । এর অবস্থান দিল্লী চিড়িয়াখানার একদম পাশেই ।
শেরশাহ যখন হুমায়ুন কে পরাজিত করে দিল্লী দখল করেন তখন দিনপানাহ এর নাম বদলে করেন শেরগাহ। পরবর্তীতে মোঘলরা তাদের রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যায় আরো দক্ষিণে – আগ্রা শহরে। ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে দিল্লী আবারও প্রধান শক্তিকেন্দ্র হয়ে ওঠে শাহজাহান এর রাজত্বকালে। শাহজাহান প্রতিষ্ঠা করেন শাহ্জাহানাবাদ যেটাকে আজকাল পুরোনো দিল্লী নামে ডাকা হয় । লাল কিল্লা , জামা মসজিদ , চাঁদনী চক এই শাহ্জাহানবাদেরই অংশ।


পরবর্তীকালে আবার ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে ১৯১১ সালে রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লী সরিয়ে নিয়ে এলে দিল্লি তার হারানো গরিমা ফিরে পায়। ব্রিটিশরা নিজেদের রাজকার্যের জন্য নিয়ে এলো এডউইন লুটিয়েন্স কে যিনি তার সহযোগী হার্বার্ট বেকার এর সাথে পরিকল্পনা করে গড়ে তুললেন আজকের নতুন দিল্লীকে যাকে এখন লুটিয়েন্স দিল্লী বলে অভিহিত করা হয়। স্বাধীনতার পর দিল্লীকে স্বাধীন ভারতের রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং লুটিয়েন্স দিল্লীকেই তার সদর দফতর করা হয়। দিল্লীর অন্যতম দ্রষ্টব্য রাষ্ট্রপতি ভবন , ইন্ডিয়া গেট সেই নতুন দিল্লীরই অংশ। বর্তমান দিল্লী শহর এই দশটি শহর কে নিয়েই গড়ে উঠেছে।


এই হল ভারতবর্ষের বর্তমান রাজধানীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ।
Picture References:
http://delhi.gov.in/wps/wcm/connect/doit_shahjahanabad/DoIT_Shahjahanabad/Home/Monuments+in+Delhi/Seven+Cities+of+Delhi
https://en.wikipedia.org/wiki/History_of_Delhi
http://www.delhitourism.gov.in/delhitourism/index.jsp
http://www.duac.org/
http://www.intach.org/
Written By
Hits: 1479